জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রতিবছর ২৬ জুন সারাবিশ্বে 'মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস' পালিত হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য :'মাদক বিষয়ে হই সচেতন, বাঁচাই প্রজন্ম, বাঁচাই জীবন।' বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক এ দিবসটি পালনের গুরুত্ব অনেক বেশি, কারণ কভিড-১৯ মহামারির সঙ্গে ধূমপান ও মাদকের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পর্কের কথা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে। ধূমপান বহু জটিল রোগের কারণ, একই সঙ্গে কভিডে মৃত্যুর প্রবণতাকে ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হলেও মাদকদ্রব্যের অবৈধ প্রবেশের ফলে এদেশের যুবসমাজ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। সরকার এরই মধ্যে মাদকের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা ঘোষণা করেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, মাদকাসক্তদের মধ্যে শতকরা ৯৮ ভাগই ধূমপায়ী এবং তার মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগই বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, খুনসহ রাজধানীতে সংঘটিত অধিকাংশ অপরাধের সঙ্গেই মাদকাসক্তির সম্পর্ক রয়েছে। একটি সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে মাদকাসক্তির কারণে প্রায় ২০০ মা-বাবা নিজ সন্তানের হাতে খুন হয়েছেন। এ কথা অনস্বীকার্য, ২০১৮ সালে শুরু হওয়া মাদকবিরোধী অভিযানের কারণে মাদক পাচার ও সরবরাহ অনেকটাই কমে গেছে। বর্তমানে করোনা মহামারির কারণে নজরদারির কিছুটা শিথিলতার সুযোগ নিচ্ছে কারবারিরা। বিভিন্ন কৌশলে দেশে মাদকের চালান আনছে তারা। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও টেকনাফের ইয়াবা কারবারিরা বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবা সরবরাহ করেই চলেছে। কুরিয়ার সার্ভিসে পাঠানো পার্সেলে এমনকি ত্রাণ বিতরণ এবং ওষুধ কেনাসহ বিভিন্ন অজুহাতে মাদক বিক্রি করছে তারা।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারির কারণে বেশ কয়েকটি দেশে নির্দিষ্ট কিছু মাদকের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। তবে, এর ইতিবাচক দিক যেমন আছে, তেমনি নেতিবাচক দিকও কম নয়। জাতিসংঘ বলছে, অনেক মাদকাসক্ত বিকল্প হিসেবে আরও মারাত্মক মাদকদ্রব্য গ্রহণ করছে। এরই মধ্যে অনেক দেশে হেরোইনস্বল্পতা দেখা দিয়েছে। সেসব দেশে এখন এমন মাদকদ্রব্য ব্যবহার করা হচ্ছে, যেগুলো স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এবং শরীরের ওপর হেরোইনের চেয়েও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। মাদকাসক্তরা অনেকেই ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে বিভিন্ন নেশাদ্রব্য প্রয়োগ করছে এবং একই সিরিঞ্জ একাধিক ব্যক্তি ব্যবহার করছে। ফলে এইচআইভি বা এইডস অথবা হেপাটাইটিস বি কিংবা সি ইত্যাদি রক্তবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে হেরোইন ও কোকেনের সংকট তৈরি হচ্ছে। জাতিসংঘের 'অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম' (ইউএনওডিসি) বলছে, দেশে দেশে লকডাউন চলার কারণে মূলত মাদকদ্রব্যের এই সংকট। এসব এলাকায় বিমান ও সড়কপথে বেশিরভাগ মাদক চালান করা হয়। করোনাভাইরাসের কারণে এই দুই রুটেই পণ্য পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে এবং এর প্রভাব পড়েছে মাদক পাচারেও। করোনা মহামারিকালীন ভারত মহাসাগরে হেরোইনের একটি বড় চালান ধরা পড়ে। এ ঘটনায় জাতিসংঘ বলছে, এই চোরাচালান প্রমাণ করে যে, নৌপথে মাদকদ্রব্য পাচারের প্রবণতা বেড়েছে।
উদ্বেগের বিষয় হলো, আমাদের দেশে ইয়াবা গ্রহণকারীর মধ্যে ৮৫ ভাগই তরুণ। তাদের অনেকেই বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে; তাদের কিডনি, লিভার ছাড়াও মস্তিস্কের স্বাভাবিক কাজকর্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জীবনীশক্তি ধ্বংসকারী ইয়াবা সেবনকারীরা অল্প সময়ের মধ্যেই মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছে এবং যৌনশক্তি হারিয়ে ফেলেছে চিরতরে। বিভিন্ন মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন ইয়াবা আসক্তদের ওপর পর্যবেক্ষণ করে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা এসব তথ্য জানিয়েছেন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন মাদক নিরাময় কেন্দ্রে প্রায় ১৫ হাজার মাদকাসক্ত চিকিৎসা নিচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় ৯ হাজার ইয়াবাসেবী। একটানা মাত্র দুই-আড়াই বছর ইয়াবা সেবনের ফলেই তারা মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাদের নার্ভগুলো সম্পূর্ণ বিকল হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে দেশে ইয়াবা আসক্তির সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করছে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
মাদক গ্রহণকারীদের কাছে ইদানীং জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সিসা। সিসা সেবন সিগারেটের মতোই ক্ষতিকর। সিসা অথবা হারবাল তামাকের কারণে মানুষ উচ্চমাত্রার কার্বন মনোঅক্সাইডজনিত সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, একবার সিসা সেবনে একটি সিগারেটের চেয়ে চার-পাঁচ গুণ বেশি কার্বন মনোঅক্সাইড গ্রহণ করা হয়ে থাকে। উচ্চমাত্রার কার্বন মনোঅক্সাইডে মস্তিস্কের ক্ষতি হতে পারে এবং অচেতন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এরই মধ্যে অনেকে ই-সিগারেটে আসক্ত হচ্ছে, বিজ্ঞানীরা বলছেন, ই-সিগারেটের মধ্যে রয়েছে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এবং পরবর্তীকালে মাদকের নেশায় আসক্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।
বর্তমান সরকার ২০১৯ সালের প্রথম দিন থেকেই মাদকবিরোধী যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় গত বছরের প্রথম দিন থেকেই সারাদেশে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান চলছে এবং প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার মাদক নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত এই অভিযান চলবে। মাদক দেশের উন্নয়নে অন্যতম বাধা বলে মনে করছে সরকার। মাদক কারবারিরা যাতে জামিনে ছাড়া না পায়, এজন্য নানা কৌশল নেওয়া হচ্ছে। সেইসঙ্গে মাদক বিক্রেতা, মাদকের বড় বড় ব্যবসায়ী ও আন্তর্জাতিক চক্রের সদস্যদের পৃথক পৃথক তালিকা তৈরি করা হয়েছে। লক্ষ্য করা গেছে, মাদকের সঙ্গে মানি লন্ডারিং আইনে মামলার যোগসূত্র রয়েছে। তাই মাদকের বিষয়টি বর্তমান সরকারের জন্য বিশেষভাবে জরুরি।
সরকারি চাকরিতে ঢোকার আগে প্রার্থীদের ডোপ টেস্ট বা মাদক পরীক্ষা করা হবে- সরকারের এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। যাদের ডোপ টেস্ট পরীক্ষার ফল পজিটিভ হবে, তারা চাকরির জন্য অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবেন। আমাদের হিসাব মতে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ লাখ। মাদকসেবীর অধিকাংশই বয়সে তরুণ। ধারণা করা হয়, আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে যাবে। আমাদের দেশে নারীদের মধ্যেও মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে। এটা উদ্বেগের কারণ। নারী আসক্তদের ৯০ ভাগের বয়স ১৫-৩৫ বছরের মধ্যে। বাদবাকি ৩৫-৪৫ বছরের মধ্যে। মাদকাসক্তদের মধ্যে শতকরা পাঁচজন নারী। তাদের মধ্যে ছাত্রী, গৃহিণী, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী রয়েছেন।
রূপকল্প ২০২১-এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও ২০৪০ সালে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়ে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ যুবসমাজকে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে মাদকমুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। দেশকে মাদকমুক্ত করার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি, বিশেষ করে ছাত্রসমাজকে টার্গেট করে মাদকবিরোধী প্রচারের কাজ করতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে। আমাদের সংগঠন 'মানস' দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে এদেশে যুবসমাজের মধ্যে মাদকবিরোধী সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
মাদকাসক্তির পেছনে বিজ্ঞানী ও গবেষকরা বিভিন্ন কারণ চিহ্নিত করেছেন। কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো-১. সমবয়সীদের চাপ, ২. মাদকের সহজলভ্যতা, ৩. বেকারত্ব ও কর্মক্ষেত্রে ব্যর্থতা, ৪. আর্থসামাজিক অস্থিরতা, ৫. মাদকের কুফল সম্পর্কে অজ্ঞতা, ৬. সমাজে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, ৭. পারিবারিক কলহ, ৮. চিকিৎসাসৃষ্ট মাদকাসক্তি, ৯. কৌতূহল, ১০. ধূমপান ইত্যাদি।
মাদকনির্ভরশীল ব্যক্তি স্বভাবতই চিকিৎসা নিতে চায় না। কারণ সে বুঝতেই পারে না যে, তার চিকিৎসার প্রয়োজন। আবার অনেকেই শারীরিক যন্ত্রণার ভয়ে মাদক চিকিৎসায় অনীহা পোষণ করে। এক্ষেত্রে পরিবারের অন্য সদস্যরা সহমর্মিতামূলক আচরণের মাধ্যমে তাকে চিকিৎসা নিতে আগ্রহী করে তুলতে পারেন। এমনভাবে আচরণ করতে হবে যাতে সে বুঝতে পারে যে, তাকে সবাই ভালোবাসে, তার সুন্দর ও সুস্থ জীবনের জন্য সবাই সহযোগিতা করতে চায়। মাদকনির্ভরশীল ব্যক্তিকে সঠিকভাবে পরিচর্যা করতে না পারলে যে কোনো সময় তার আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে। মাদকনির্ভরশীল ব্যক্তির চিকিৎসার সব পর্যায়ে পরিবারের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা প্রয়োজন।
একটি কথা না বললেই নয় যে, মাদকাসক্তি শুরু হয় ধূমপান দিয়ে। পরবর্তী সময়ে তারা গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন ও কোকেনে আসক্ত হয়। করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে আমরা যেমন মাস্ক ব্যবহার করি, হাত সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড ধুই এবং সেইসঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখি, তেমনি অন্যান্য ঝুঁকি থেকেও আমাদের দূরে থাকতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, জীবন ব্যবস্থার পরিবর্তন করা এখন জরুরি। সুতরাং, করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে ধূমপায়ী ও মাদকাসক্তদের নেশা ত্যাগ করার জন্য চিকিৎসার মাধ্যমে (কাউন্সেলিং/রিহ্যাব) সুস্থ করা এখন সময়ের দাবি। আজকের দিনে এই আমাদের প্রত্যাশা।
অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারি, বারডেম হাসপাতাল; সদস্য, জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা কমিটি
prof.arupratanchoudhury@yahoo.com
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন